Blogs

বিপণন বিবর্তনঃ ডিরেক্ট সেল্স থেকে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং

লেখকঃ এম. রহমান আরিফ, বইঃ বিপণন বিবর্তন পৃষ্টা নং-

ডিরেক্ট সেল্‌স পদ্ধতিতে উৎপাদনকারী নিজে বা লোক মারফত সরাসরি ভোক্তার নিকট পণ্য বিক্রয় করে। ডিরেক্ট সেলার বা সরাসরি বিক্রেতা হিসেবে যারা পরিচিত তাদের মধ্যে ফেরিওয়ালা, পরিভ্রমনকারী বিক্রেতা ও কাবুলিওয়াল৩দের (উপমহাদেশে) আনাগোনা দেখা যেত বেশি। সাধারণত এরা বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পণ্য বিক্রয় করতো কেউ কেউ আবার দল বেঁধে গ্রামগঞ্জের হাট বাজারে পণ্য বিক্রয়ের জন্য পসরা সাজিয়ে বসতো।

ঐতিহাসিক বিনিময় প্রথার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় একটি পণ্য প্রাপ্তির জন্য অন্য একটি পণ্য প্রদান করার বিধান ছিল যাকে ‘বারটার’ (Barter) বলা হতো। কৃষিজ পণ্যের সাথে গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় পণ্য, বস্ত্র ইত্যাদি বিনিময় করাই ছিল এ বারটার পদ্ধতির উদ্দেশ্য। মুদ্রা প্রথা চালুর পূর্ব পর্যন্ত এ পদ্ধতির প্রচলন ছিল।

সভ্যতার শুরুতে মিশর, সিরিয়া, ব্যবিলনীয়া ও ইন্ডিয়াতে ব্যবসায়িক প্রথা চালু ছিল। প্রাচীন গ্রীকের সাথে এশিয়ার এসব দেশের গৃহস্থালীর যন্ত্রপাতি, রান্নাঘর সামগ্রী, কাপড় ইত্যাদি আদান-প্রদান হতো। বর্তমান তুর্কী ( যা পূর্বে এন্তোনিয়া নামে পরিচিত ছিল) এলাকার লোকজন গাঁধার পিঠে চড়ে কাপড় বিক্রয় করে বেড়াতো।

পাঁচশত খ্রিষ্টাব্দের দিকে এথেন্সে সরাসরি বিপণনের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। প্রস্তুতকারীরা কোন ধরনের মধ্যস্থকারবারীর সহযোগিতা ব্যতীত তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ক্রেতাদের নিকট বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উৎসব ও মেলার আয়োজন করতো। খ্রিস্টাব্দে ১০০০ এর দিকে সমত্র বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সস্ত্র্ত্রসারন হতে শুরু করে, এর ফলে ডিরেক্ট সেলারদের বান্যিজিক কার্যক্রম প্রসার পেতে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দরুন বিক্রেতাদের কায্যক্রম আরও সহজতর হতে থাকে। দূর দুরান্ত হতে পণ্য সামগ্রী গ্রামগঞ্জে বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে। ফ্রান্সে, ডিরেক্ট সেলাররা বড় বড় শহরগুলো থেকে নতুন পণ্য সামগ্রী এনে  বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছিল gd¯^j ও গ্রামগঞ্জে পাশাপাশি ডিরেক্ট সেলারদের কাছ থেকে কেনা সুঁতি সিল্কের বেল্ট, মহিলাদের ওড়না, পিতলের দ্রব্যাদি, ইত্যাদির মাধ্যমে বড় বড় দোকানগুলো সজ্জিত হতো।

আমেরিকার বিখ্যাত ইয়াংকিরা ঘোড়ায় চড়ে সুঁই, পিন, কাঁচি, চিরুনী, পারফিউম জাতীয় পণ্য ফেরি করতো। পর্যায়ক্রমে তারা পশ্চিমাঞ্চল ও কানাডায় বিক্রয় কার্যক্রম চালাতে থাকে।  ব্যবসার সুবিধার্থে তারা পানিপথ ব্যবহার করতো বেশি। ইউরোপিয়ন যাযাবররা নতুন নতুন স্থানে সরাসরি পণ্য বিক্রয় করতো তাঁরা দল বেঁধে একস্থানে সাময়িক আবাস তৈরি করে এবং কাছাকাছি স্থানে পণ্য বিক্রয় শেষে পুনরায় নতুন স্থানে গিয়ে আবাস গড়তো। সাধারণত ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, জার্মানীসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশগুলোতে ইউরোপিয়ান যাযাবরদের বিচরণ ছিল বেশি বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই ডিরেক্ট সেল্‌স এর ছোঁয়া লেগেছিল।*

বাজার প্রথা চালুর পূর্ব পর্যন্ত ডিরেক্ট সেল্‌স বা সরাসরি বিক্রয় পদ্ধতি ছিল সমগ্র বিশ্বব্যাপী পণ্য বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম এরপর বিপণনের বিবর্তন ঘটতে থাকে, বাজার পদ্ধতি চালূ হওয়ার সাথে সাথে মধ্যস্থ কারবারির সংখ্যা বাড়তে থাকে, ক্রেতা বা ভোক্তারা পূর্বের তুলনায় অধিক মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে অনেকটা বাধ্য হলো অর্থাৎ বাজারের নিয়ন্ত্রন পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়।

ঊনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরুতে পুনরায় ডিরেক্ট সেল্‌স বা সরাসরি বিক্রয়ের আর্বিভাব হয়। এবং এ পদ্ধতির অনেকটা উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। উৎপাদনকারীর কাছ থেকে লোকজন পণ্য ক্রয় করে তা বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশিদের কাছে ¯^í লাভে বিক্রয়ের প্রচলন ঘটে। পরবর্তীতে হোম বেইজ বিক্রয় প্রথা চালু হয়।

ঊনিশশত চল্লিশের দিকে সরাসরি বিক্রয় প্রথার এক চমৎকার আর্বিভাব ঘটে।

আমেরিকার বিখ্যাত কেমিস্ট ডঃ কাল রেইন বোর্গ তার উৎপাদিত কৃত্রিম ভিটামিন (যা আয়োডিন ও ভিটামিন ‘ই’ এর  সংমিশ্রনে তৈরী) বাজারজাত করনের জন্য সর্বপ্রনম বহুমাত্রিক পদ্ধতি এর ধারনা প্রবর্তন করেন। পাশাপাশি ‘ক্যালিফোনিয়া ভিটামিন, নামে একটি কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন যা বিশ্বের প্রথম নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানী বলে ¯^xK…wZ পায়। কারন ১৯৪০ সালের শুরুতে এটিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার বিক্রয় কার্যক্রম ছিল বহুস্তরে বিভক্ত, যে ধারনা) হতে জন্ম নেয় বহুমাত্রিক বিপণন পদ্ধতি বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং পদ্ধতি। ডিরেক্ট সেল্‌স ও নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এ দুটোর সূল পার্থক্য স্পন্সরিং অর্থাৎ ডাউন লাইন হতে প্রাপ্ত কমিশন। বর্তমানে মাল্টিলেভেল কিংবা সিঙ্গেল লেভেল সবক্‌টিই ডিরেক্ট সেল্‌স এর অর্ন্তভূক্ত।

১৯৫৯ সালে Nutilite Product Inc. (যার পূর্ব নাম ক্যালিফোনিয়া ভিটামিন, এর দুজন শীর্ষস্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটর Amway Corporation নামে নতুন নেটৗয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। এমওয়ে কপোরেশন বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একটি কোম্পানী। ১৯৫৮-৫৯ সালের দিকে আমেরিকান পার্লামেন্টে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতি আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৫-৭৯ সনে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতির বৈধতার প্রশ্ন তোলে আমেরিকান সংস্থা FTC (Federal Trade Commission) নেটওয়ার্ক পদ্ধতির উপর নিষেধাক্তা আরোপ করে। এমওয়ে কপোরেশন এ নিষেধাক্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়। FTC ও Amway Corp. এর এই মামলাকে Amway Safeguard বরে বিবেচনা  করা হয়। পরবতীতে এ মামলার রায়ে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতি বৈধতা লাভ করে। মূলত ভোক্তা বা ক্রেতার অধিকার সংরক্ষণ ও পিরামিড স্কীমের ব্যবহার বন্ধের উদ্দেশ্যে FTC এমন পদক্ষেপ গ্রহন করে।

বর্তমানে আমেরিকায় প্রায় দুইশত এর বেশি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানী কার্যরত এর প্রতিটি কোম্পানীর শাখা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। ২০০০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ৫৫ভাগ আমেরিকান নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতিতে পণ্য ক্রয় করে এবং ৫০ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যভহার করে পণ্য ক্রয় করে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ১৯৬৩ সালে জাপানে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতি চালু হয়। বর্তমানে এশিয়াতে প্রায় সব কটি দেশে এ পদ্ধতি বিস্তার লাভ করছে। এমনকি চীনেও এ পদ্ধতির জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালয়শিয়ার প্রতিটি মানুষ কোন কোন এম এল এম প্রতিষ্ঠানের সহিত জড়িত তারা ঘরে বসেই প্লান প্রদর্শন করে ও স্পন্সর তৈরী করে। আমাদের দেশে উদেক্তার অভাব ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরনের অভাবে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছেনা। এ পদ্ধতির সম্ভাবনা বাংলাদেশে খুবই উজ্জ্বল।

বর্তমানে মোবাইল ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। সমগ্র বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে ব্যবসাকে করেছে গতিশীল ও সমৃদ্ধশালী। বিপণন পদ্ধতি নিত্য পরিবর্তিত হচ্ছে সংযোগ ঘটছে নতুন প্রযুক্তির বিপণনের এ বিবর্তন আগামী কাল হয়তো অন্য রূপ ধারন করবে। পুরোনো ধ্যান-ধারনা বা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আমাদেরও দৌঁড়াতে হবে সময়ের সাথে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে।

Related posts

Leave a Comment